কিন্তু ছায়াপথে খুঁজে না আলো স্যুটেড বুটেড মানুষ


কবিতায় সমাজ-বাস্তবতা, বহির্মুখী প্রচারণার চলমান সময়ে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গতিময় সংকটে আত্মজিজ্ঞাসার অভিপ্রায়ী অন্তর্মুখী কবি ও কবিতার সংখ্যা খুবই কম। আধুনিকুত্তর বাংলা কবিতায় বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রভাবও যে আবশ্যিকতার দাবি রাখে তা কবি সাজিদুল হক এর "আততায়ীর অপেক্ষায়" পাঠ পরবর্তী উপোলদ্ধি। কবিতা লেখা যে শুধুমাত্র ভাবাবেগ ও বৈকরণিক চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ না তা অনেকখানি স্পষ্ট করে দিয়েছে এই গ্রন্থটি।
সুন্দর সময়ে লিখিত কবিতায় উপকরণ হিসেবে পেতে অভ্যস্ত প্রেম,কাম ও নারী আর দুঃখের সময়ে বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব। বাংলা কবিতায় এই প্রতিবিপ্লবের গোড়াপত্তন বিহারীলালকে দিয়ে। তিনিই প্রথম অনুষংগে এনেছেন প্রবাহমান ধারা থেকে ভিন্নতা। তিনিই সাবজেক্টিভ ঘরনার কবিতা চর্চায় এগিয়ে আসেন প্রথম । বাংলা কবিতার ইতিহাসে বৈকরণিক রীতি ভেংগে গদ্য কবিতার সূচনায় রবীন্দ্রনাথের নাম আসলেও বিস্তৃতি পায় জীবনানন্দকে দিয়ে । নিভৃতচারী গত হওয়া এই কবি এখনো বেঁচে আছেন পাঠকের মগজে। সময় এখানেই পরাজিত। কবি সাজিদুল হক এই পরাজিত সময়ের কাছে সৌপর্দ করেছেন আর্তনাদ।
"মহাদেশ ঘুরে পুঁতে রাখা নোঙরের
সন্ধানে ব্যস্ত দিকভ্রান্ত অভিযাত্রিক;
আমি এখনো সময়ের কাছে
সমর্পিত আর্তনাদ।"
চলমান এই সংশয়বাদী দ্বান্ধিকতাপূর্ণ এই বিশ্বে এমন ভাংগাগড়াকে বিশ্বাস,সম্পর্ক ও নির্ভরতার ভিতে পোক্ত করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই আর্তনাদ যে শুধু কবি স্ব-দিকভ্রান্তির(দ্বান্দ্বিকতা) জন্য নয় তাও বুঝা যায় "পাথর নির্মিত", "আদিম স্বপ্নের স্বভাবে" শীর্ষক কবিতায়।
"বইয়ের মলাট উল্টালেই শব্দের গতি নিয়ে চলে গ্রহান্তরে
স্বপ্নঘোরে সে মানুষ ফিরেছে আবার উলঙ্গ স্বভাবে
মুক্তি হুজুরের তাবিজে!
.........." (আদিম স্বপ্নের স্বভাবে)।
"পাথর নির্মিত" কবিতায় বলেছেন ,
"অর্ধনারীর জীবনে নেই পূর্ণসত্য।"
অর্থাৎ স্থবির জীবন তাঁদের। এই ধ্রুবতা আমাদের ইন্দ্রিয়ে ধ্রুব হয়ে আছে। কবি উপোলদ্ধি করেছেন তাঁদের জীবনও পাথরের মতো স্থির। প্রতীকী আদলে নির্মিত এই কবিতার শেষ চরণগুলোতে আমাদের নির্মম বাস্তবতা, জীবনবৈষম্যে কবির তৎফরতা দেখা দেয়।
" উদাস মনের আকুলতায় ঝড় ওঠে শরীরে
তবুও বন্ধ হয়ে যায় সকল দুয়ার
প্রহরীর রাগী চোখের নির্দেশ
মহলের অন্দরে প্রবেশ নিষেধ।" ( পাথর নির্মিত )
অন্য কোনো সুরঞ্জনাতে কবির ভাষাগত বৈচিত্রতা সৃষ্টিতে যে প্রচেষ্ট তা `আততায়ীর অপেক্ষায়` অনেকটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। নিজস্ব ভাষাশৈলীসম্পন্ন এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় সমসাময়িক বৈষয়িক বাস্তবতা বিশেষত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোর দুর্বলতা এবং হতাশজনক পরিস্থিতি কবিকে তাড়িত করেছে বারংবার তা স্পষ্টত। যেমন-
"..........
আমাদের নীরবতার সুযোগ নিয়েছে
জমির খতিয়ান উভয়পক্ষ বুঝে নিলেও
লাশের হদিস পেল না উপমহাদেশের কেউ
সবাই শিখেছে একটি মন্ত্র
আমি মুসলিম
আমি হিন্দু
...........।" ( যাযাবর )
এই কবিতাটি আমাদের যেমন নিয়ে যাবে সাতচল্লিশের বিভেদের সময়ে তেমনি মেলাতে পারেন বর্তমান সম্প্রদায়গত বিদ্বেষে পরিপূর্ণ ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের প্রাসংগিকতা।
প্রাসংগিকতাকে এড়িয়ে কবিতা টিক কবিতা হয়ে উঠে না। বর্তমান বিশ্বের প্রায়ই রাষ্ট্র ধর্ম দ্বারা আক্রান্ত। বিশেষ ধর্মীয় গৌষ্ঠী সংখ্যায় গৌণদের অবিশেষ বিবেচনা করে হাঁটে অন্ধকারের দিকে। মানুষ এইক্ষেত্রে আর মানুষ থাকে না। হয়ে উঠে আক্রমনাত্মক। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করে একশ্রেণি। অর্থাৎ ধর্মকে চিরকালই ব্যবহার করেছে অস্ত্ররূপে বিশেষজ্ঞ এক গৌত্র। ফলে সমাজে ঘটেছে এক সম্প্রদায় থেকে অন্য সম্প্রদায়ে স্থানান্তরের মতো ঘটনা। বাস্তব চিত্রের নিরিখে কবির ভাবনায় বস্তুত স্থান পায় নানা বিষয়বস্তু।
"বালক বেলা থেকে মা যে সুরে
শেখালো কথামালা
তার কতটুকু পাল্টেছি
ধর্মত্যাগের সাথে?" ( আমি ধর্মত্যাগী না ধর্মান্তরিত )
এই প্রশ্নটি অমূলক নয় মোটেই। আমরা দেশ,ধর্ম,জাত কিংবা পরিবার থেকে যতোই বিচ্ছিন্ন হয় না কেন আসলে কতটুকু বদলানো যায় শেখড়ীয় অভিধান! কবিতাটি শুরু আকস্মিক ভাবে না হলেও পঠনকালে মাঝখানে এসে থেমে যেতে হয় এই কটি চরণে
"...............
আমি ধর্মত্যাগী নাকি ধর্মান্তরিত
জন্মেছি দেবতার আশির্বাদে
এখন দিন কাটে তসবি সালাতে।
...." ( আমি ধর্মত্যাগী না ধর্মান্তরিত )।
কাব্যের অনুষংগ বদলাচ্ছে। সাথে বদলাচ্ছে সমাজবোধ। খোলা মাঠ হতে গুহা আর গুহা থেকে কাচঘর। সামনের কোনো এক সময়ে অদৃশ্য ফ্রেমে যাপন করতে শিখবে মানুষ। সভ্যতার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কিছু মানুষ প্রথার বাইরে (পেছনমুখী নয়) চলার সাহস নিয়ে পথ চলছেন নিভৃতে। এই পথের যাত্রী কাব্য শিল্পেও বর্তমান। কবিতায় আত্মপ্রবণতা কবিতাকে গড়ে তুলে শৈল্পিক দ্বান্ধিকতায়।
“ আমি বিশ্বাসে ফিরিয়ে দিলাম তোমাকে
একটি রাতের স্পর্শ আমাকে কীভাবে
ভোলাবে তোমার বিশ্বাসঘাতকতা" ( আমি কীভাবি ভুলি )
এই যে ভোলা না ভোলার দ্বন্দ্ব, এই দ্বিদ্বা থেকে বেরিয়ে কবি ডুব দেন কাঁকনের শব্দে। কবিকে উদ্বেলিত করে লতানো জবান।
" এমন লতানো জবানে ডাকেনি কেউ
চোখে ছিলো তরবারির নিঁখুত ধার
হাতের কাঁকনের শব্দ বলেছে বারেবার
যদি চাও আমি হবো তোমার বউ
..........।" ( কাঁকনের শব্দ )
" প্রার্থনা শেষে
আবারও
ফিরে পেলো যুবতীর উষ্ণতায় মধ্যাহ্ন
শুধুই একরাত্রি সরেছিলো নাভিদেশ থেকে
বুঝেছি বস্ত্তত এই আমাদের জীবনবোধ।" ( তীরবিদ্ধ স্বপ্ন )
স্বাভাবিক ঘোরে অনাবদ্ধ কবি ভেবেছেন এই বদ্বীপ নিয়ে। এখানে সরলমনার আধিক্য থাকলেও বিশ্বাসঘাতকেরা প্রাধান্য পেয়েছে যথারীতি। উপনিবেশ থেকে উপ-উপনিবেশ এরপরেই জাতির পিতার হাত ধরে আমাদের বাংলাদেশ। দুর্ভাগ্য পিতৃহননের বদলা আমরা এখনো নিতে পারেনি।
দেশজ নিপীড়করা উদ্ধ্যত দেখিয়েছে বারবার। জাতি নিশ্চুপ। নেই প্রতিবাদ। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াকে নিয়তি মেনে যাপনে ব্যস্ত জাতির অনেকাংশ। যথাযোগ্য শাস্তি রাষ্ট্র দিতে পারেনি। বরং দর্শয়িতার বেশে চলছে রাজনৈতিক প্রহসন। এসব অনিয়ম দায়বদ্ধতার অভিপ্রায়ে কবিকে নাড়া দিয়েছে তা বোঝা যায় `ঘৃণায় দহন করো` কিংবা “ঘুরে এসেছি মধ্যযুগে” `র মতো কবিতায়।
"জল নয় রক্তে ধুঁয়ে শব্দাবলী
..........
যে বধ্যভূমি দেখতে পাও না অহংবোধ থেকে
জন্ম নেওয়া পৌরুষ চোখে;
চার দশক বিধবার ছায়াতলে ধরে রেখেছে রক্তচিহ্ন
……......"। ( ঘৃণায় দহন করো )
বীরাংগনাদের দুঃখকে তুলে এনে কবি বয়ান করলেন একই কবিতায়
"……….......
গোপনে রেখেছিলো ভয়ানক সেই অপরাধ
তোমাদের কাছে স্বীকার করেনি মৃত্যুর আগেও।
মন চাইলে পিতৃহত্যাকারীদের দাও দন্ড
...........।" ( ঘৃণায় দহন করো )
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সম্প্রদায়গত ব্যবধান তুলে দিয়েছিলো জনকের মৃত্যুর পরেই আমাদের জাতিগত পরিচয় সম্প্রদায়গত। আমি মুসলিম। আমি বৌদ্ধ আর আমি হিন্দু। কেউ বলে না আমি মানুষ। এটি এখনব্দি বিদ্যমান। এই প্রবণতা পুরো বিশ্বজুড়েই। দখলদারিত্বই যেন টিকে থাকার অন্যতম স্তম্ভ!
" খুনের নেশায় মেতেছে জাতি ধর্ম
জাতিসংঘ, কত খুন হলে ঘুম ভাঙবে তোমার?
…….............।" ( দখিনা হাওয়ায় রক্তের ঘ্রাণ )
পাথর নির্মিত কবিতায় সমাজে অবহেলিত শ্রেণির প্রতি যে দায়বদ্ধতার গান কবি গেয়েছেন কিতাবে চেনা অক্ষরে সেই শ্রেণিকে ব্যবহার করেছেন ভিন্ন রূপকে।
" কতিপয় নপুংসকের দখলে ভায়াগ্রার বাজার
তুমিই দেখ না কেবল তারুণ্যের ক্ষয়াকাশ
ক্ষমতা কী তবে হিজড়াদের হাতের মুঠোয়।" ( কিতাবে চেনা অক্ষর )
মহলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপে কবি যেখানে বেদনাবোধ জাগিয়েছেন তার আবেশ এই কবিতায় নেই। বরং উল্টো প্রতিক্রিয়া, কিছুটা বিদ্রুপ এই কবিতাতে পাই। আবার একই কবিতায় প্রেমিকের বিবস্ত্র বুকে জাগিয়েছেন বিরহগাঁথা।
কবিতার মতো একটি সচেতন শিল্প তখনই সাফল্য ও স্বার্থক বলে স্বীকৃতি হবে যখনি সমাজ পোষিত মানবিক গুণাবলির মহত্তম স্ফুরণে সামাজিক প্রত্যাশার তীক্ষ্ম দাবি কবিতায় সামিল হবে। এই স্বীকৃতি কবি নয় বৌদ্ধা পাঠকগণ নির্ধারণ করে এসেছেন যুগে যুগে। সময় এখানে নির্ধারক।
" আহত সব পাখি সিরিয়ার আকাশ সীমানা ছেড়ে
কোথায় পালাবে?
..................
শিশুদের রক্ত থেকে জন্ম নেওয়া লাল গোলাপে
মনে হয় রক্তাক্ত শিশুদের মুখ
সময়ের কাছে পরাজিত বর্তমান রাখেনি অতীত।" ( পরাজিত )
কবি যখন বলেন,
" তার স্বরে বলেই যাচ্ছ
গোলাপ কখনো হতে পারে না গুপ্ত ঘাতক
তোমার আশ্রয়ে আততায়ী
নিঃশব্দে দাঁড়ায় বন্ধুতারবন্ধনে;
আততায়ী থেকে কীভাবে আলাদা করবে
ঘাতকের রক্তে রঞ্জিত গোলাপে তোমার দুই উপকূল?" (আততায়ী প্রেম )
তখন আর কিছু কি বলার লাগে ? এই তো আমাদের জীবন বোধ। স্যুটেড ব্যুটেড যাপনের ফাঁকে আমরা কয়জনই বা খুঁজি এইভাবে আলো ?

Comments

Popular posts from this blog